ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৬ মে ২০২৪

যুগে যুগে মেডিটেশন: ধর্ম ও বিজ্ঞানের আলোকে 

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২২:৫৩, ১২ সেপ্টেম্বর ২০১৮

যুগে যুগে মানুষ মেডিটেশন বা ধ্যানকে আত্ম উপলব্ধির জন্যে ব্যবহার করে আসছে। ধর্মীয়ভাবে হাজার হাজার বছর ধরে ধ্যানের চর্চা হয়ে আসছে। অন্যদিকে বর্তমান আধুনিক এই বিজ্ঞানের যুগে মেডিটেশন এক অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রোগ মুক্তি থেকে শুরু করে জীবনের সব ক্ষেত্রেই এখন মেডিটেশনের ব্যবহার বৃদ্ধি পেয়েছে।  

ধ্যান মেডিটেশন মোরাকাবা, তাফাক্কুর- শব্দগুলো ভিন্ন হলেও মূল নির্যাস একই। বিভিন্ন ধর্ম আর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এটি প্রায়োগিকভাবে ভিন্ন রূপ নিলেও পানির সার্বজনীনতার মতোই ধ্যানের নির্যাস সার্বজনীন, সকল মানুষের জন্যে।

“নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন-রাত্রির আবর্তনে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে, বসে বা শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ধ্যানে (তাফাক্কুর) নিমগ্ন হয় এবং বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি কর নি।” [সূরা আলে ইমরান : ১৯০-১৯১]

প্রাচ্যের হাজার বছরের ঐতিহ্য এই ধ্যান, মোরাকাবা বা মেডিটেশনই এখন পাশ্চাত্যে জনপ্রিয় হচ্ছে। প্রয়োগ হচ্ছে মূলত প্রশান্তি ও আত্মনিরাময় লাভের ক্ষেত্রে।

৫০০০ বছর আগের লিখিত নিদর্শন

প্রাচীন মানুষ যে ধ্যান বা মেডিটেশন চর্চা করতেন তার লিখিত প্রমাণের বয়সই কমপক্ষে পাঁচ হাজার বছর। ৫ হাজার বছরের প্রাচীন ভারতীয় তন্ত্রশাস্ত্রে ধ্যানের উল্লেখ আছে। এটি সতের শতকের একটি দুর্লভ উপনিষদ পান্ডুলিপির খণ্ডাংশ। এখানে ধ্যানের কথা বলা আছে।

মোজেস বা মুসা

ইহুদি ধর্মের প্রাণপুরুষ মোজেস বা মুসা সিনাই পাহাড়ে ৪০ দিন ধ্যানমগ্ন থেকে আল্লাহর বাণী লাভ করেন। তাওরাতে পিতা আইজ্যাকের সান্ধ্যকালীন প্রার্থনার জন্যে মাঠে যাওয়া প্রসঙ্গে হিব্রুতে যে ‘লাসাচ’ (Lasuach) শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে, এটা আসলে ধ্যানেরই একটি পরিভাষা।

মহেঞ্জোদারো সভ্যতা

ধ্যানচর্চার প্রাচীন ইতিহাসের আরো কিছু নিদর্শন মিলেছে মহেঞ্জোদারো সভ্যতার ধ্বংসাবশেষে। আজ থেকে ৪৬০০ বছর আগে সিন্ধু অববাহিকা অঞ্চলে বিকশিত এ সভ্যতার একটি প্রাচীন সিলমোহরে দেখা যায় ধ্যানাসনে বসে একজন যোগী গভীর ধ্যানে মগ্ন।

মহামতি বুদ্ধ

মহামতি বুদ্ধ ধ্যানের পথে বোধি লাভ করেছেন। ধ্যানের মাধ্যমেই নির্বাণ লাভের পন্থা শিখিয়েছেন অনুসারীদের। তাঁর ধ্যান পদ্ধতিকে ইউরোপ-আমেরিকায় এখন নানাভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে বিভিন্ন শারীরিক-মানসিক নিরাময়ের ক্ষেত্রে।

যিশু

যিশুখ্রিষ্টের জীবনে ধ্যান এবং প্রার্থনা হয়ে গিয়েছিল একাকার। যখনই সুযোগ পেতেন তিনি ধ্যান ও প্রার্থনায় নিমগ্ন থাকতেন। শিষ্যদেরও উৎসাহিত করতেন ধ্যানমগ্ন হতে।

হযরত মোহাম্মদ (স)

মহানবী হযরত মোহাম্মদ (স) বছরের পর বছর হেরা গুহায় কাটিয়েছেন ধ্যানমগ্ন অবস্থায়। ধ্যানের স্তরেই পবিত্র কোরআনের বাণী নাযিল হয়েছে তাঁর ওপর।

পবিত্র কোরআনের সূরা আলে ইমরানের ১৯০-১৯১ আয়াতে বলা হয়েছে-

“নিশ্চয়ই আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে, দিন-রাত্রির আবর্তনে জ্ঞানীদের জন্যে নিদর্শন রয়েছে। তারা দাঁড়িয়ে, বসে বা শায়িত অবস্থায় আল্লাহকে স্মরণ করে। তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ধ্যানে (তাফাক্কুর) নিমগ্ন হয় এবং বলে, হে আমাদের প্রতিপালক! তুমি এসব অনর্থক সৃষ্টি কর নি।”

কোরআনের আরো বেশ কটি আয়াতে তাফাক্কুর বা তাদাব্বুরের যে কথা বলা হয়েছে, তা আসলে সৃষ্টিরহস্য নিয়ে ধ্যানেরই তাগিদ।

অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান

অতীশ দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান। আজ থেকে হাজার বছর আগে বাংলার এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ ধ্যানের শিক্ষা দিয়ে উপমহাদেশ, তিববত ও চীনের সমাজ-জীবনের পঙ্কিলতা দূর করতে নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।

ইমাম গাজ্জালী

ইমাম গাজ্জালী। দীর্ঘ ১০ বছর নির্জনবাসের মধ্য দিয়ে উপলব্ধি করেন আত্মশুদ্ধি এবং ধ্যানের পথেই মুক্তি। শরিয়তের সাথে সাধনাকে সম্পৃক্ত করে তিনি ইসলামি জীবনদৃষ্টির পুনর্জাগরণ ঘটান। পরবর্তী হাজার বছরে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের সাধক-দার্শনিকদের তিনি গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন। শুধু তাই নয়, তার লেখা থেকেই পাওয়া যায় যে, হযরত ইমাম বোখারীও মেডিটেশন করতেন।

হযরত মওলানা জালালুদ্দিন রুমি

বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী কবি দার্শনিক হযরত মওলানা জালালুদ্দিন রুমি। তিনি মোরাকাবায় নতুন মাত্রা যোগ করেন নৃত্য সংযোজন করে। তাঁর স্রষ্টায় সমর্পণ এবং বিশ্বজনীন প্রেমের দর্শন শতাব্দী পরিক্রমায় প্রভাবিত করে এসেছে চিন্তাশীলদের। বহু ভাষায় অনুদিত হয়েছে তাঁর রচনা। আমেরিকায় সবচেয়ে বেশি পঠিত কবিদের একজন তিনি। তাঁর প্রেমের কবিতা অবলম্বনে রচিত গানের এলবাম স্থান পেয়েছে বিলবোর্ড টপচার্টে। টাইম ম্যাগাজিন তাঁকে মিস্টিক অফ দি ইয়ার হিসেবে উল্লেখ করে বলে, "The sufi sect of the whirling dervishes dances to his rhyme. New age meditation echo his songs." ২০০৭ সালে ইউনেস্কো তাঁর ৮০০ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করে এবং ‘শান্তির সপক্ষে মানুষের হৃদয়ে স্থান’ শীর্ষক অবদানের স্বীকৃতি দেয়।

কবি হাফেজ সিরাজী

ইরানের কবি হাফেজ সিরাজী সুফিধারার সবচেয়ে জনপ্রিয় কবি।

মধ্যযুগীয় সুফিধারা

সুফিধারায় ধ্যান বা মেডিটেশনের অবস্থান উল্লেখযোগ্য। জিকর বা স্রষ্টার স্মরণ এবং ফিকর বা আত্মমগ্ন ভাবনার চর্চার ধারাই পরে পরিণত হয়েছে বিশেষ প্রক্রিয়ার ধ্যানে। ১৬৩০ সালের একটি ছবিতে একজন সুফিকে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় দেখা যায়।

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী

বাবা লোকনাথ ব্রহ্মচারী। বিশ্বাস, ভক্তি ও ভালবাসার সহজ সরল শিক্ষার মধ্য দিয়ে যিনি হয়ে উঠেছেন বাংলার লক্ষ ঘরে স্মরণীয় মহামানবে।

শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস

শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস। ইংরেজ শাসনাধীন উপমহাদেশে এক বৃহৎ জনগোষ্ঠীর আত্মিক পুনর্জাগরণের সূচনা করেন। বুদ্ধিজীবী ও সাধারণ মানুষের কাছে ধ্যান ও আধ্যাত্মিকতাকে সমাদৃত করে তোলেন।

স্বামী বিবেকানন্দ

শ্রীরামকৃষ্ণের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯৩ সালে শিকাগোর বিশ্বধর্মসভায় তাঁর বিখ্যাত ভাষণ প্রাচ্যের আত্মিক ও আধ্যাত্মিক বিজয়ের সূচনা করে। পাশ্চাত্য অনুভব করতে পারে তাদের অন্তঃসারশূন্যতা। আধ্যাত্মিকতার প্রসারের জন্যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে বেদান্ত সোসাইটি এবং ভারতে রামকৃষ্ণ মিশন প্রতিষ্ঠা করেন।

হযরত এনায়েত খান

সুফিবাদের আন্তর্জাতিক ধারার প্রবর্তক হযরত এনায়েত খান। ইউরোপ এবং আমেরিকায় তিনিই ধ্যানের এই ধারাকে জনপ্রিয় করে তোলেন।

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র

ঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। তিনি বলেছিলেন, বাংলা জাগলে ভারত জাগবে... জগৎ জাগবে...। একেশ্বরবাদ এবং সকল ধর্ম ও মতসহিষ্ণুতা ছিল তাঁর শিক্ষার ভিত্তি। সবাইকে তিনি মিলিতভাবে সাধনার পথে ডাক দিয়েছেন।

মহাঋষি মহেশ যোগী

মহাঋষি মহেশ যোগী ষাটের দশকে পাশ্চাত্যে বেদান্ত দর্শনকেন্দ্রিক টিএম-কে পরিচিত করান। পরবর্তীতে যা পাশ্চাত্যের মিডিয়া এবং জনজীবনে ধ্যানচর্চাকে জনপ্রিয় করতে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে।

দালাই লামা

তিববতের আধ্যাত্মিক নেতা চতুর্দশ দালাই লামা। বুদ্ধের ধ্যান পদ্ধতিকে পাশ্চাত্যের বুদ্ধিজীবী ও বিজ্ঞানী মহলে প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

নতুন যুগের সূত্রপাত

১৯৬৯-১৯৭০ দশকে মেডিটেশন চর্চায় নতুন যুগের সূত্রপাত হয়। নতুন নতুন পদ্ধতির আবির্ভাব ঘটে। এর মধ্যে টিএম, বা ট্রান্সেনডেন্টাল মেডিটেশন, সহজ যোগ, ন্যাচারাল স্ট্রেস রিলিফ, ফাইভ রিদম, থিটা হিলিং, সিলভা মেথড, ডা. হার্বার্ট বেনসনের রিলাক্সেশন রেসপন্স, ডা. কাবাত জিনের মাইন্ডফুলনেস বা মনোনিবেশায়ন উল্লেখ্যযোগ্য।

ধর্মের আলোকে মেডিটেশন

ধর্মাচার ভিন্ন হলেও সব ধর্মের মূলবাণী একই। আর তা হলো অনৈতিকতা ও পাপ-পঙ্কিলতা থেকে মুক্ত হয়ে আদর্শ জীবন গঠন। আত্মপর্যালোচনা এবং আত্মউপলব্ধির মাধ্যমে নিজের পরিবর্তন।

আর এই উপলব্ধির প্রক্রিয়ায় ধ্যান বা মেডিটেশনকে পৃথিবীর সব ধর্মেই বিবেচনা করা হয়েছে একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হিসেবে।

ধ্যান একটি সার্বজনীন প্রক্রিয়া। বিভিন্ন ধর্ম আর সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে এর প্রয়োগ ভিন্নরূপে হলেও ধ্যানের নির্যাস সকল মানুষের জন্যে একই। যুগে যুগে দেশে দেশে সাধকরা আত্ম উপলব্ধির জন্যে এ প্রক্রিয়াকে ব্যবহার করেছেন।

সনাতন ধর্মে ধ্যান

মহাভারত, বেদ ও উপনিষদে বলা হয়েছে, ধ্যানে মগ্ন হলে একজন মানুষ আত্মার সন্ধান পেতে পারে নিজের মাঝেই। ভগবতগীতায় ধ্যানযোগের ওপর রয়েছে বিশেষ অধ্যায়। আর পতাঞ্জলির সময় থেকে যোগসাধনায় সংযুক্ত হয়েছে ধ্যান, যার পরিণতি সমাধির স্তরে।

বৈদিক হিন্দুধর্মের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র হলো গায়ত্রী মন্ত্র। এ মন্ত্রকে বলা হয় সমস্ত মন্ত্রের জননী। পন্ডিত সত্যকাম বিদ্যালংকারের অনুবাদ দি The Holy Vedas এ রয়েছে —

O Supreme Lord
Thou art ever existent, ever conscious, ever blissful. We meditate on Thy most adorable glory. Mayest Thou guide and inspire our intellect on the path of highest divinity! May we be able to discriminate between truth and falsehood. (Rig.3.62.10)

সদাসর্বত্র বিরাজমান তন্দ্রা-নিদ্রাহীন সদা সজাগ প্রতিনিয়ত করুণা বর্ষণকারী সর্বশক্তিমান হে প্রভু! আমরা শুধু তোমারই মহিমার ধ্যান করি, প্রভু হে! তুমি আমাদের সর্বোত্তম আলোকিত পথে পরিচালিত করো। [ঋগ্বেদ : ৩.৬২.১০]

রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী স্থিরাত্মানন্দজী মহারাজ। ২০০৯ সালে কোয়ান্টাম মুক্ত আলোচনার এক বিশেষ সেশনে তিনি সনাতন ধর্মে ধ্যান বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

বৌদ্ধ ধর্মে ধ্যান

বৌদ্ধ ধর্মমতে ধ্যান বা মেডিটেশনই হলো নির্বাণপ্রাপ্তির উপায়। দুঃখসংক্রান্ত চতুরার্থ সত্য উপলব্ধির পর মহামতি বুদ্ধ এর প্রতিকারের জন্যে যে দুই ধর্মচক্রের কথা বলেন, তার প্রথম হলো মধ্যপন্থা অনুসরণ অর্থাৎ জীবনে অতি সুখ-বিলাস-ব্যসন যেমন পরিত্যাজ্য, তেমনি অতি সংযম ও কৃচ্ছ্রসাধনও অপ্রয়োজনীয়। আর ২য় ধর্মচক্রে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গে তিনি আটটি সৎপথের কথা বলেন। আর তা হলো, সৎদৃষ্টি, সৎসংকল্প, সৎবাক্য, সৎকর্ম, সৎজীবিকা, সৎপ্রচেষ্টা, সৎস্মৃতি এবং সৎসমাধি। আর এর যথার্থ উপলব্ধির জন্যে একজন মানুষকে মেডিটেশন বা ধ্যানে আত্মমগ্ন হতে হবে।

বুদ্ধের মতে মেডিটেশনের প্রাপ্তি হলো দুটি–এক, সমাধি বা স্থিরতা যা মনকে কেন্দ্রীভূত করে; দুই, বিপাসন বা প্রজ্ঞা, যা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরেও উপলব্ধির চেতনাকে জাগ্রত করে। ফলে একজন মানুষ তার স্থান-কালের সীমা অতিক্রম করে ত্রিকাল দর্শনের অভিজ্ঞতা লাভ করেন।

অর্থাৎ মহামতি বুদ্ধ ধ্যানের পথে বোধি লাভ করেছেন। ধ্যানের মাধ্যমেই নির্বাণ লাভের পন্থা শিখিয়েছেন অনুসারীদের।

২০০৯ সালে কোয়ান্টাম মুক্ত আলোচনার এক বিশেষ সেশনে `মহামতি বুদ্ধের জীবন ও শিক্ষা` বিষয়ক এক বিশেষ আলোচনায় আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বৌদ্ধব্যক্তিত্ব, বাংলাদেশ বৌদ্ধকৃষ্টি প্রচার সঙ্ঘের সভাপতি ও ধর্মরাজিক বৌদ্ধ মহাবিহারের অধ্যক্ষ মহামান্য শুদ্ধানন্দ মহাথের এ বক্তব্যই তুলে ধরেন।

খ্রিষ্ট ধর্মে ধ্যান

যিশুখ্রিষ্টের জীবনে ধ্যান এবং প্রার্থনা হয়ে গিয়েছিল একাকার। যিশুর শক্তির উৎস ছিল তাঁর ধ্যান, তাঁর প্রার্থনা—যে ধ্যানে তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতেন। যে প্রার্থনা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, প্রার্থনায় যা-কিছু তোমরা চাও, বিশ্বাস করবে তা পেয়েছ, তাহলে তা-ই পাবে। সারাদিন ধরে ভক্ত-শিষ্য-অভ্যাগতদের সাথে সময় কাটানোর পর সন্ধ্যাবেলা খানিকটা নির্জনে গিয়ে তিনি প্রার্থনায় নিমগ্ন হতেন, ভুলে যেতেন সমস্ত ক্ষুধা-ক্লান্তি-অবসাদ। অন্যদেরকেও তিনি বলতেন, অনেক কাজ করেছ, এখন ধ্যান করো। নিজেকে পর্যালোচনা করো, ভুলগুলো খুঁজে বের করো, মনের পর্দায় নিজেকে দাঁড় করাও, জীবন পরিবর্তন করো।

যিশুখ্রিষ্টের এ আদর্শের অনুসরণে যারা অনুপ্রাণিত, তারা চর্চা করেন খ্রিষ্টীয় মেডিটেশন। স্রষ্টার মহিমা ও বাণী নিয়ে বিশেষ প্রার্থনা। খ্রিষ্টীয় মেডিটেশনের একজন একনিষ্ঠ প্রবক্তা সেইন্ট পিয়েত্রিলসিনা। তিনি বলেন, বাইবেল পড়ে একজন মানুষ স্রষ্টাকে খোঁজে, আর মেডিটেশনের মধ্য দিয়ে সে স্রষ্টাকে পায়।

যিশুখ্রিষ্টের জীবনে ধ্যান বিষয়ে আরো বিস্তারিত আলোচনা করেন ফাদার পৌলিনুস কস্তা। ঢাকার আর্চবিশপ পৌলিনুস কস্তা বাংলাদেশে খ্রিষ্টান সম্প্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ।

ইসলাম ধর্মে ধ্যান

ইসলামে ধ্যান বা মেডিটেশনকে একটি উচ্চস্তরের ইবাদত হিসেবে গণ্য করা হয়। মুসলমানদের সবচেয়ে পবিত্র গ্রন্থ কোরআনের বহু জায়গায় সরাসরি মেডিটেশনের কথা বলা হয়েছে। কোরআনে যে শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে তা হচ্ছে তাফাক্কুর। এর অর্থ হচ্ছে কনটেমপ্লেশন, মেডিটেশন বা ধ্যান। সূরা আলে ইমরানের ১৯০-৯১ আয়াতে আল্লাহ জ্ঞানীদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে বলেছেন, ‘তারা আকাশ ও পৃথিবীর সৃষ্টিরহস্য নিয়ে গভীর ধ্যানে (তাফাক্কুর) নিমগ্ন হয়’।

আল কোরআনের সূরা আনআমে আল্লাহ বলেন, হে নবী! ওদের জিজ্ঞেস করো, অন্ধ ও চক্ষুষ্মান কি কখনো সমান হতে পারে? তোমরা কি এরপরও (কোরআনের শিক্ষা অনুধাবনে) গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হবে না (বা তোমাদের সহজাত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করবে না)? (আনআম: ৫০ )

সূরা সাদে আল্লাহ বলেন, হে নবী! আমি তোমার ওপর এই কল্যাণময় কিতাব নাজিল করেছি, যাতে মানুষ এই কোরআনের বাণী নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়! (সেইসাথে সহজাত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে) এর শিক্ষা অনুসরণ করে।

একইভাবে সূরা মুহাম্মদের ২২, ২৩, ২৪ আয়াতে আল্লাহ বলেন, (হে নবী! ওদের জিজ্ঞেস করো) তোমরা যদি (আল্লাহর আনুগত্য থেকে বেরিয়ে পুরনো ধ্যানধারণায়) ফিরে যাও, তবে কি তোমরা দুনিয়ার বুকে পুনরায় বিপর্যয় সৃষ্টি করবে? বন্ধন ছিন্ন করে পরস্পর বিবাদ-বিসংবাদে লিপ্ত হবে? এদেরকেই আল্লাহ তার রহমত থেকে বঞ্চিত করেন, (সত্যের ব্যাপারে) বধির ও অন্ধ করেন। এরপরও কি ওরা কোরআন নিয়ে গভীর ধ্যানে নিমগ্ন হয়ে তা অন্তরে ধারণ করবে না? নাকি মনের দরজা বন্ধই করে রাখবে?

আল্লামা ইউসুফ আল কারযাভী বর্তমান বিশ্বের একজন সর্বজনমান্য ইসলামি চিন্তাবিদ। তিনি ১৯৭৩ সালে আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উসূল আদ-দ্বীন অনুষদ হতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। তিনি মিশর সরকারের বোর্ড অফ রিলিজিয়াস এফেয়ার্স-এর সদস্যপদসহ আন্তর্জাতিক বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি ইউরোপিয়ান কাউন্সিল ফর ফতোয়া এন্ড রিসার্চ-এর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেছেন, মেডিটেশন বা ধ্যান হচ্ছে উচ্চস্তরের ইবাদত।

বিশিষ্ট গবেষক ও মনোবিজ্ঞানী অধ্যাপক মালিক বাদরি’র মেডিটেশন বিষয়ক গ্রন্থ `Contemplation : An Islamic Psycho-Spiritual study` -এর ভূমিকায় ইউসুফ আল কারযাভী বলেন, ‘গ্রন্থকার তার গ্রন্থে ধ্যান ও প্রশান্ত মনে সৎচিন্তার আলোকে বিচার করার ব্যাপারে ইসলামের নির্দেশনাকে বিস্তারিত বিশ্লেষণ করেছেন’।

হাদীসেও ধ্যানের গুরুত্ব বর্ণিত হয়েছে। হযরত ইবনে আব্বাস থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, এক ঘণ্টার ধ্যান সারা বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম। এছাড়া হযরত আবু হুরাইরা থেকে বর্ণিত আছে, নবীজী (স) বলেছেন, সৃষ্টি সম্পর্কে এক ঘণ্টার ধ্যান ৭০ বছরের নফল ইবাদতের চেয়ে উত্তম (মেশকাত)।

বছরের পর বছর হেরা গুহায় যে তিনি ধ্যানে কাটিয়েছেন, তা তো সবাই জানেন। তিনি যে মেডিটেশন করতেন তা বোঝা যায় বিশিষ্ট ইসলামী চিন্তাবিদ ড. তারিক রামাদানের The Messenger : The meanings of the life of Muhammad বই থেকে। সেখানে তিনি বলেছেন, He did not demand of his companions the worship, fasting and meditation that he exacted of himself. অর্থাৎ রসুলুল্লাহ (স) যেভাবে ইবাদত করতেন, রোজা রাখতেন এবং মেডিটেশন করতেন, তিনি তাঁর অনুসারীদের ওপর সে কঠোরতাকে চাপিয়ে দিতে চান নি। অনেক কিছু তিনি নিজে করেছেন কিন্তু অন্যদের জন্যে বলেছেন, তোমরা করলেও করতে পারো।

দেশে-বিদেশে কোয়ান্টাম মেথড মেডিটেশনের হাজার হাজার চর্চাকারীদের মধ্যে রয়েছেন সব ধর্মের অনুসারীরাই। কারণ কোয়ান্টাম বিশ্বাস করে সকল ধর্মের মূল শিক্ষা এক। স্থান কাল ভাষা পরিবেশ অনুসারে ধর্মাচারে পার্থক্য রয়েছে। স্বধর্ম পালন ও অন্যের ধর্মপালনের অধিকার নিশ্চিত করাই ধর্মের শিক্ষা। কোরআন কণিকার পাশাপাশি বেদ ও গীতা কণিকা, বাইবেল ও ধম্মপদ কণিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে সকল ধর্মের প্রতি কোয়ান্টামের শ্রদ্ধাবোধেরই প্রকাশ ঘটেছে। বাংলাদেশের সংখ্যালঘু তিনটি প্রধান ধর্মের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিত্বরাও সাদরে আমন্ত্রিত হয়েছেন কোয়ান্টামে, আলোচনা করেছেন ধ্যান, ধর্ম আর নৈতিকতা নিয়ে।

মেডিটেশন: বিজ্ঞানের চোখে

মেডিটেশন হচ্ছে বিজ্ঞান। এটা অলৌকিক কিছু নয় বা নয় কোনো আশ্রম, খানকা বা শ্রেণি সম্প্রদায়ের বিষয়। বরং মেডিটেশন হলো এক সার্বজনীন কল্যাণ প্রক্রিয়া। মেডিটেশন চর্চা করে নারী-পুরুষ, কিশোর-বৃদ্ধ, পাপী-পুণ্যাত্মা নির্বিশেষে প্রতিটি মানুষ শারীরিক মানসিক সামাজিক ও আত্মিক কল্যাণ লাভ করতে পারেন। গত ৬০ বছরের অসংখ্য বৈজ্ঞানিক গবেষণার মধ্য দিয়ে এটা এখন এক প্রমাণিত সত্য।

‘এভরিবডি সে ওম’

নিউসায়েন্টিস্ট ম্যাগাজিনে ৮ জানুয়ারি, ২০১১ সংখ্যায় মেডিটেশনের ওপর একটি বিশেষ নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। ‘এভরিবডি সে ওম’ শিরোনামের এ প্রচ্ছদ নিবন্ধে মেডিটেশন নিয়ে এ যাবৎকালের সবচেয়ে ব্যাপক গবেষণার ফল তুলে ধরা হয়। নিবন্ধে বলা হয় — মেডিটেশন শুধু সাধকদের জন্যে নয় বা এ থেকে উপকার লাভের জন্যে বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। যে-কেউ মেডিটেশন করে উপকৃত হতে পারে। মেডিটেশনে সময় ব্যয় করা হচ্ছে ফলপ্রসূ সময় ব্যয়।

ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর মাইন্ড এন্ড ব্রেন’-এর বিজ্ঞানী ক্লিফোর্ড স্যারনের নেতৃত্বে একদল গবেষক অনেকদিন ধরে মেডিটেশন করছেন এমন ৬০ জন স্বেচ্ছাসেবীর ওপর তিন মাস পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালান।

মেডিটেশন মনোযোগ বাড়ায়

প্রথম পরীক্ষাটি ছিল মনোযোগ নিয়ে। কম্পিউটার স্ক্রিনে অনেকগুলো খাড়া খাড়া দাগ দেখিয়ে স্বেচ্ছাসেবীদের বলা হয়, এগুলোর মধ্যে যখনই বাকিগুলোর চেয়ে ছোট কোনো দাগ তাদের চোখে পড়বে তৎক্ষণাৎ মাউস ক্লিক করে তারা যাতে সেটাকে চিহ্নিত করে। বিজ্ঞানীরা দেখলেন, যত বেশি সময় গড়াচ্ছে ধ্যানীরা তত নির্ভুলভাবে ছোট দাগগুলোকে শনাক্ত করতে পারছেন।

মেডিটেশন যে মনোযোগ বাড়ায় তা অবশ্য আগের আরো বেশ কয়েকটি গবেষণা থেকেও প্রমাণিত। উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের পরীক্ষায় দেখা গেছে, নিয়মিত মেডিটেশন করে স্বেচ্ছাসেবীরা বিভিন্ন স্বরের পার্থক্যকে খুব সহজে বুঝতে পারছে। জার্নাল অব নিউরোসায়েন্সে এ গবেষণার ফলাফলটি প্রকাশিত হয়।

মেডিটেশন মানসিক প্রতিক্রিয়ার প্রবণতা কমায়

সামাথা প্রকল্পের দ্বিতীয় গবেষণাটি ছিল আবেগ-অনুভূতির ওপর মেডিটেশনের প্রভাব নিয়ে। যে প্রক্রিয়ায় গবেষণাটি চালানো হয় তা-ও খুব মজার। এর আগে স্বেচ্ছাসেবীদের যে-রকম ছোট দাগ দেখলে মাউসে ক্লিক করতে বলা হয়েছিল, এবার তাদের বলা হলো লম্বা দাগগুলোকে ক্লিক করতে।

কাজটা একাধারে একঘেয়ে, বিরক্তিকর এবং বেশ ধৈর্যসাপেক্ষও। কারণ অনেকক্ষণ ধরে আসা লম্বা দাগগুলোর পরে হঠাৎ হঠাৎ আসত ছোট দাগগুলো। একদিকে দীর্ঘ সময় ধরে লম্বা দাগে ক্লিক করা এবং ছোট দাগগুলোকে ক্লিক করা থেকে বিরত থাকা — মধ্য দিয়ে বিজ্ঞানীরা দেখতে চাচ্ছিলেন বিরক্তি বা একঘেয়েমিজনিত আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করার দক্ষতা তাদের কতটা বেড়েছে।

গবেষকদলের নেতা বালজিন্ডার সাহাদ্রা বলেন, আমরা দেখলাম, মেডিটেশন চর্চার ফলে স্বেচ্ছাসেবীদের টেনশন করার প্রবণতা কমেছে; বেড়েছে নেতিবাচক আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ক্ষমতা। মেডিটেশন একজন মানুষের রি-একটিভিটি বা মানসিক প্রতিক্রিয়ার প্রবণতা কমায়।

ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেকটি গবেষণায়ও দেখা গেছে, মেডিটেশন ব্রেনের এমিগডালা অংশের তৎপরতাকে নিয়ন্ত্রণ করে ব্যক্তির আবেগকে সংহত করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখে। এটিও প্রকাশিত হয় ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্সের জার্নালে।

সবচেয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে মানুষের শারীরিক-মানসিক সুস্থতায়

বিজ্ঞানীরা বলেন, মেডিটেশনের ফলে সবচেয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে মানুষের শারীরিক-মানসিক সুস্থতায়। কিছু অসুস্থতা যেমন — ক্ষুধামান্দ্য, বদহজম, মাদকাসক্তি, দুরারোগ্য চর্মরোগ সোরিয়াসিস, ডিপ্রেশন এবং ক্রনিক ব্যথা সারাতে মেডিটেশনের কার্যকর ভূমিকা দেখা গেছে।

মেডিটেশন বার্ধক্যকে নিয়ন্ত্রণ করে

মেডিটেশন বার্ধক্যকেও নিয়ন্ত্রণ করে। সামাথা প্রকল্পের আরেকটি গবেষণায় দেখা গেছে, মেডিটেশনের ফলে দেহে টেলোমেরেজ নামে একটি এনজাইমের উৎপাদন বেড়ে যায়, যা কোষের বুড়িয়ে যাওয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে। এ-সংক্রান্ত লেখাটি এসেছে জার্নাল ‘সাইকো-নিউরো-এনডোক্রাইনোলজি’-তে।

মেডিটেশন অন্যের প্রতি আবেগ-অনুভূতিকে বাড়ায়

সামাথা প্রকল্পের সবচেয়ে আলোচিত গবেষণাটি হচ্ছে, মেডিটেশন অন্যের প্রতি আবেগ-অনুভূতিকে বাড়ায় কিনা। দীর্ঘদিন মেডিটেশন করেছেন এমন ব্যক্তিদের ব্রেনের ফাংশনাল MRI করে গবেষক লাজ এবং তার সহযোগীরা দেখেন, ইনসুলা বা এন্টেরিওর সিংগুলেট করটেক্সের মতো মস্তিষ্কের যে অংশগুলো মমতা, অন্যদের প্রতি ভালবাসা ইত্যাদি অনুভূতিকে জাগ্রত করে, তাদের মস্তিষ্কে তা অনেক বেশি সক্রিয়। নিউরো-ইমেজ জার্নালে এটি প্রকাশিত হয়েছে।

২০০৯ সালে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে খোলা হয় সেন্টার ফর কমপ্যাশন এন্ড আলট্রুয়িজম রিসার্চ এন্ড এডুকেশন। নাম শুনেই বুঝতে পারছেন এই ইনস্টিটিউটের কাজ হলো মমতা সহানুভূতি সমমর্মিতা ইত্যাদি মানবিক আবেগগুলোর নিউরোবায়োলজিকেল যোগসূত্র বোঝা, গবেষণা করা। এই ইনস্টিটিউটের সাথে নিউরোসায়েন্টিস্টরা যেমন আছেন, আছেন সিলিকন ভ্যালির বড় বড় বিনিয়োগকারীরা এবং আছেন তিব্বতীয় ধর্মগুরু দালাইলামা। তাদের সবার একটাই উদ্দেশ্য। আর তা হলো, মেডিটেশন চর্চা করে কীভাবে একজন মানুষ অন্যের প্রতি তার নিঃস্বার্থ মমতা, সহানুভূতি, সহমর্মিতা সৃষ্টি করতে পারে।

আর এসব উদ্যোগের ফলেই বোধ হয় মেন্টাল ট্রেনিং জিমনেসিয়ামের মতো ধারণার উদ্ভব ঘটেছে, যেখানে গিয়ে একজন মানুষ তার আবেগকে জাগ্রত করার অনুশীলন করবে, বাড়াবে তার সহমর্মিতার অনুভূতি যে-রকম সে জিমে গিয়ে বাড়াতে পারে তার পেশির কার্যকারিতা।

আপনি যে-ই হোন বা যেখানেই থাকুন, মেডিটেশন থেকে আপনি উপকৃত হবেনই

এসব গবেষণার মধ্য দিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যে সত্যটি বেরিয়ে এসেছে তা হলো, আপনি যে-ই হোন বা যেখানেই থাকুন, মেডিটেশন থেকে আপনি উপকৃত হবেনই। আপনাকে এজন্যে মেডিটেশনে বিশেষজ্ঞ হতে হবে না, দিনে পাঁচ ঘণ্টা করে অনুশীলন করতে হবে না, ঘরবাড়ি ছেড়ে জঙ্গলেও যেতে হবে না।

মেডিটেশনের ব্যথানিরোধক ক্ষমতার ওপর মনোবিজ্ঞানী ফিদেল জাইদানের গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতিদিন ২০ মিনিট করে মাত্র তিন দিন অনুশীলন করেই উপকার পেতে শুরু করেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। তার দ্বিতীয় গবেষণায়ও দেখা গেছে, অল্পসময়ের জন্যে একটুখানি মেডিটেশন করেই বেড়ে গেছে তাদের মনোযোগের ক্ষমতা, বেড়েছে বড় বড় সংখ্যা মনে রাখা ও বলতে পারার দক্ষতা। তার এই গবেষণালব্ধ তথ্য বেরিয়েছে কনশাসনেস এন্ড কগনিশন জার্নালে।

প্রতিদিন ৩০ মিনিট অনুশীলন করেই দৃশ্যমান পরিবর্তন

প্রখ্যাত মেডিটেশন গবেষক রিচার্ড ডেভিডসন এজন্যেই বলেন, দেহ-মনের ওপর মেডিটেশনের প্রভাব এত তাড়াতাড়ি পড়ে যে, আমরা আমাদের গবেষণায় দেখেছি, একদল নতুন মানুষ মেডিটেশন শেখার পর মাত্র দুই সপ্তাহ প্রতিদিন ৩০ মিনিট অনুশীলন করেই তার মস্তিষ্কের কর্মকাঠামোয় ঘটাতে পেরেছে দৃশ্যমান পরিবর্তন।

তাই বলা যায়, মন ও মস্তিষ্কের বিশাল কর্মক্ষমতা নিয়ে এখন যে লাগাতার গবেষণা চলছে, তা থেকে প্রতিনিয়তই বেরিয়ে আসছে মেডিটেশনের ইতিবাচক ফলাফলের নতুন নতুন তথ্য।

মেডিটেশন ও ব্রেনওয়েভ

আমরা জানি বিশ্রাম, তন্দ্রা বা নিদ্রাকালীন সময়ে অবচেতন মন সবচেয়ে সৃজনশীল থাকে ও ভালোভাবে কাজ করে। আর বিশ্রাম বা তন্দ্রাকালীন সময় দেহ-মন পুরোপুরি শিথিল হয়ে গিয়ে ব্রেন ওয়েভ নেমে যায় প্রতি সেকেন্ডে ১৩ থেকে ৪ সাইকেলে, বিজ্ঞানের পরিভাষায় আলফা/ থিটা লেভেলে।

আসলে সক্রিয় অবস্থায় ব্রেন থেকে প্রতিনিয়ত খুব মৃদু বিদ্যুৎ তরঙ্গ বিকিরিত হয়। বিজ্ঞানীরা একে বলেন, ব্রেন ওয়েভ। ১৯২৯ সালে ডা. হ্যান্স বার্জার ইলেকক্ট্রো এনসেফেলোগ্রাফ (ইইজি) যন্ত্র দ্বারা এই ওয়েভ বা তরঙ্গ মাপেন। মানসিক চাপ, সতর্কতা, তৎপরতামূলক পরিস্থিতিতে ব্রেনের বৈদ্যুতিক বিকিরণ বেড়ে যায়। তখন ব্রেন ওয়েভের ফ্রিকোয়েন্সি দাঁড়ায় প্রতি সেকেন্ডে ১৪ সাইকেল থেকে ২৬ সাইকেল পর্যন্ত। একে বলা হয় বিটা ব্রেন ওয়েভ।

চোখ বন্ধ করে বিশ্রামকালে একটু তন্দ্রা তন্দ্রা ভাব সৃষ্টি হলে ব্রেনের বৈদ্যুতিক তৎপরতা কমে যায়। এ অবস্থায় ব্রেন ওয়েভের ফ্রিকোয়েন্সি দাঁড়ায় প্রতি সেকেন্ডে ৮ থেকে ১৩ সাইকেল। একে বলা হয়, আলফা ব্রেন ওয়েভ। থিটা ব্রেন ওয়েভ আলফার চেয়ে ধীর। এর ফ্রিকোয়েন্সি হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ৪ থেকে ৭ সাইকেল।

এরপর রয়েছে গভীর নিদ্রাকালীন ব্রেন ওয়েভ। এর ফ্রিকোয়েন্সি হচ্ছে প্রতি সেকেন্ডে ০.৫ থেকে ৩ সাইকেল। একে বলা হয় ডেল্টা ব্রেন ওয়েভ। ব্রেন ওয়েভ ফ্রিকোয়েন্সি প্রতি সেকেন্ডে ২৭ বা তার ওপরে উঠে যেতে পারে হঠাৎ উত্তেজিত অবস্থার ফলে। একে বলা হয় গামা ব্রেন ওয়েভ।

এখন যদি আমরা কৃত্রিমভাবে শিথিলায়নের (Relaxation) মাধ্যমে শরীর-মনে বিশ্রাম ও তন্দ্রাকালীন আবহ সৃষ্টি করতে পারি, তাহলেও ব্রেন ওয়েভ নেমে আসবে আলফা/থিটা লেভেলে। আর ব্রেন ওয়েভকে আলফা/ থিটা লেভেলে নামিয়ে আনতে পারলেই ধ্যানাবস্থা সৃষ্টি হবে। অবচেতন মনের গভীরের শক্তিকে কাজে লাগানোর পথ হবে মুক্ত। আপনি প্রবেশ করতে পারবেন মনের আরও গভীরে। সচেতন মন যেমন অবচেতনকে যথাযথ নির্দেশ প্রদান করতে ও সৃজনশীলভাবে কাজে লাগাতে পারবে, তেমনি পারবে অচেতন বলয়ের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে। আর অবচেতন তখন সেই নির্দেশকে বা ধারণাকে যুক্তিসঙ্গত পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্যে অনুকূল ব্রেন ফ্রিকোয়েন্সিতে নিরলস কাজে নেমে পড়বে।

শরীর-মনকে শিথিলায়নের মাধ্যমে ব্রেন ওয়েভকে আলফা লেভেলে নিয়ে মনের ধ্যানাবস্থা সৃষ্টিই হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন, মন নিয়ন্ত্রণ, মেডিটেশন বা পরিকল্পিত ধ্যানের প্রথম ধাপ। আর ধ্যান বা মেডিটেশনের প্রয়োজনীয়তাও এখানেই।

এসি   

 


Ekushey Television Ltd.


Nagad Limted


© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি